যুগের উৎকর্ষতায় ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স

Author : Apurbo Kumar Paul Date published : Nov. 27, 2024, 1:32 a.m. Read time : 8 mins

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অটোগ্রাফের বদলে এই কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের খাতায়। সহজে উপভোগ্য সৌন্দর্য উপেক্ষিত হয়, কবি সেটাই তাঁর কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমি যদি আপনাকে প্রশ্ন করি, ”আচ্ছা আপনি আপনার চারপাশে কি দেখেন?” আপনি হয়তো বলবেন, ”এ আবার কেমন বোকার মতো প্রশ্ন, কত কিছুই তো দেখি, বলে শেষ করা যাবে না।” কিন্তু আপনি যেটা বলেও শেষ করতে পারবেন না, সেটা আমি এক শব্দে বর্ণিত করতে পারি, তা হচ্ছে “matter” (এর বাংলা আক্ষরিক প্রতিশব্দ ”বস্তু” , কিন্তু আমি পুরো লেখাতে ম্যাটার শব্দটিই ব্যবহার করেছি)। আপনার চারপাশে আপনি যা দেখেন, যা ধরতে পারেন, স্বাদ বা গন্ধ নিতে পারেন, এসব কিছুই ম্যাটার (বস্তু)। অন্য কথায় বলতে গেলে, আমাদের পৃথিবী কিংবা মহাবিশ্বেও সমস্ত কিছুই ম্যাটার দিয়ে গঠিত। আমরা যে বায়ু প্রশ্বাসের জন্য গ্রহণ করি, যে মাটিতে চলাফেরা করি, যে খাবার খাই কিংবা আমাদের চারপাশের উদ্ভিদ, প্রাণী সবকিছুই ম্যাটার দিয়ে তৈরি। এমনকি আপনিও ম্যাটার দিয়ে তৈরি। আচ্ছা আমরা একটু বিজ্ঞানের আলোকে ম্যাটারকে বোঝার চেষ্টা করি। ম্যাটার হচ্ছে এমন পদার্থ, যার ভর এবং আয়তন আছে। সমস্ত ম্যাটারই পরমাণু দিয়ে গঠিত, আবার পরমাণু ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন দিয়ে গঠিত। গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস এবং লিউসিপাস সর্বপ্রথম ধারণা করেছিলেন যে, সমস্ত ম্যাটারই কণার সমন্বয়ে গঠিত।


”ম্যাটার” থেকেই এসেছে ”ম্যাটেরিয়াল” (এর বাংলা আক্ষরিক প্রতিশব্দ ”উপাদান”, কিন্তু আমি পুরো লেখাতে ম্যাটেরিয়াল শব্দটিই ব্যবহার করেছি)। ”ম্যাটার” এবং ”ম্যাটেরিয়াল” দুটি শব্দের মধ্যে গোলমাল লেগে যেতে পারে। ধরুন, আপনার বাড়ির উঠানে একটি গাছ আছে, আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন গাছটি কেটে সেই গাছের কাঠ দিয়ে ঘরের দরজা তৈরি করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আপনি গাছটি কাটলেন, তারপর গাছটিকে স’মিলে নিয়ে গিয়ে ঘরের দরজার পরিমাপ অনুসারে কেটে কাঠ তৈরি করলেন এবং সর্বশেষ দরজা তৈরি করলেন। এবার লক্ষ্য করুন, আপনার বাড়ির উঠানে যখন গাছটি ছিল, তখন গাছটি ম্যাটার। আর আপনি যখন দরজা তৈরির লক্ষ্যে গাছটি কাটলেন এবং পরিমাপ অনুসারে কাঠ তৈরি করলেন, তখন সেই কাটা গাছটি বা তার কাঠগুলো কিন্তু আর ম্যাটার না, সেটা এখন ম্যাটেরিয়াল কারণ আপনার লক্ষিত বস্তু ”ঘরের দরজা” এই কাঠ দিয়েই তৈরি করেছেন। সুতরাং ম্যাটেরিয়াল হচ্ছে কোন কাজে প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ম্যাটার।

গাছ (ম্যাটার) কাঠ (ম্যাটেরিয়াল) দরজা ( লক্ষিত বস্তু)

ম্যাটেরিয়ালের ক্ষেত্র অপরিসীম এবং বৈচিত্র্যময়। ঐতিহাসিকভাবে, ম্যাটেরিয়ালের মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেদের উত্থান শুরু হয়েছিল এবং ম্যাটেরিয়ালের উপর ভিত্তি করেই সভ্যতার যুগের নামকরণ করা হয়েছে। নৃতাত্ত্বিকেরা হাতিয়ারের ক্রমবিকাশের ধারা অনুশীলন করে মানব সভ্যতার বিকাশের ঐতিহাসিক যুগের যে ধারা চিহ্নিত করেছেন তা হলো - প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ এবং লৌহ যুগ। কেননা এই হাতিয়ারের ক্রমবিকাশের ধারা অনুশীলন করেই অরণ্যচারী আদিম মানুষের ক্রম বিবর্তন অনুশীলন করা যায়। হাতিয়ার কাকে বলে? যা হাতে নিয়ে আমরা পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করি। যেমন- আমাদের কাস্তে কুড়াল, তীর ধনুক, কোদাল হাতুড়ি সবকিছু্ই। কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করা মানে? আসলে, ওখানেই তো বাকি সব জানোয়ারের সাথে মানুষের মস্ত বড় তফাত। বাকি সবাই বেঁচে থাকে পৃথিবীর মুখ চেয়ে, পৃথিবীর দয়ার উপর নির্ভর করে। মানুষ কিন্তু এ-রকম অসহায়ের মতো, নিরুপায়ের মতো বেঁচে থাকতে রাজি নয়। মানুষ শিখেছে পৃথিবীর কাছ থেকে নিজের দরকার মতো জিনিস জোর করে আদায় করে নিতে। তাই মাটির বুক চিরে ফসল আদায় করা, মাটি পুড়িয়ে আর পাথর কেটে বাড়ি গাঁথতে শেখা। আর মানুষ যে পৃথিবীকে এমন করে জয় করতে শিখেছে তার আসল কারণ হলো মানুষের ওই হাতিয়ার। আর এই হাতিয়ারই ম্যাটেরিয়ালের প্রাচীন নিদর্শন। কালের অতিক্রমে মানুষ আকাশকে জয় করবার জন্যে মানুষ উড়োজাহাজ বানিয়েছে, পাতালকে জয় করবার জন্যে পরেছে ডুবুরীর পোশাক আর মহাকাশকে জয় করতে তৈরি করেছে রকেট। তাম্র যুগ পেরিয়ে লৌহ যুগ হয়ে মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে আজকের অবস্থাতে পৌঁছতে ম্যাটেরিয়ালের ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি। ম্যাটেরিয়ালের যাত্রা সেই পাথর থেকে শুরু হলেও বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত প্রায় ৩,০০,০০০ ম্যাটেরিয়াল রয়েছে (আপনি যদি প্রতি সেকেন্ডে একটি ম্যাটেরিয়ালের নামও বলেন, তবুও তার তালিকা তৈরি করতে আপনার তিন দিন-রাতের বেশি সময় লাগবে )।

ম্যাটেরিয়ালের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে বিজ্ঞানে যুক্ত হয়েছে নতুন ক্ষেত্র, তা হলো ”ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স”। মানুষ যখন থেকে তামা আবিষ্কার করে, তখন থেকেই ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সের পথ চলা শুরু। ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স বিজ্ঞানের পুরনো ক্ষেত্র হলেও, অ্যাকাডেমিকভাবে ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্ট্রার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সের পথচলা শুরু। তারপর দ্রুতই বিশ্বের সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স বিভাগ রয়েছে।

ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স ম্যাটেরিয়ালের বৈশিষ্ট্যগুলো এবং সেই বৈশিষ্ট্যগুলো কীভাবে ম্যাটেরিয়ালের গঠন এবং কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত হয়, তা অধ্যয়ন করে। ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স ম্যাটেরিয়ালের আনবিক গঠন ও রাসায়নিক স্বভাবের উপর ভিত্তি করে ম্যাটেরিয়ালকে ৪ ভাগে বিভক্ত করেছে -

  1. ধাতব ম্যাটেরিয়াল :
  2. ধাতব ম্যাটেরিয়াল বলতে খাঁটি ধাতু ( টাইটেনিয়াম, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, রূপা ) এবং সংকর ধাতুকে ( যা দুই বা ততোধিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত, তবে তাতে কমপক্ষে একটি ধাতব উপাদান থাকতেই হবে ) বোঝায়। ধাতব ম্যাটেরিয়ালগুলোতে প্রচুর পরিমাণে নন-লোকালাইজড ইলেকট্রন থাকে, এই ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট কোন পরমাণুর সাথে আবদ্ধ নয়। এই ইলেকট্রনগুলো ধাতুর অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য জন্য সরাসরি দায়ী। যেমন - ধাতু খুব ভালো তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী। তাছাড়া ধাতু বেশ শক্তিশালী হয়ে থাকে, যার ফলে কাঠামোগত অ্যাপ্লিকেশনে তাদের ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে।
    আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধাতব ম্যাটেরিয়ালই একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। বাড়ি বানাতে প্রয়োজন হয় টিন-রড, খাবার তৈরি করতে গেলে প্রয়োজন অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল, খাওয়ার সময় স্টিলের থালা-বাসন আর নিজেদের সুজ্জিত করতে ব্যবহার করি স্বর্ণ বা রূপার অলংকার, এই সমস্ত কিছুই ধাতব ম্যাটেরিয়াল।
  3. পলিমারিক ম্যাটেরিয়াল :
  4. পলিমার শব্দটি গ্রিক শব্দ ’পলি’ (Poly) অর্থ বহু বা অনেক এবং ’মেরোস’ (Meros) অর্থ অংশ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। অর্থাৎ পলিমার বলতে একই ধরনের অনেকগুলো ছোট ছোট অংশ যুক্ত হয়ে যে উচ্চ আনবিক ভরবিশিষ্ট বৃহদাকার অণু তৈরি হয় তাকে বোঝায়। এক কথায় বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু পর পর যুক্ত হয়ে পলিমার অণু গঠন করে থাকে। যে ক্ষুদ্র অণু যুক্ত হয়ে পলিমার তৈরি করে তাকে মনোমার (Monomer) বলা হয়। তুলা, রেশম, পশম, সিল্ক, নাইলেনের সুতা, পাট, কার্পেট, রাবার, পলিথিন, পিভিসি পাইপ, মেলামাইনের থালা-বাসন আমাদের খুবই পরিচিত। এগুলো বিভিন্ন পলিমার বা পলিমারিক ম্যাটেরিয়াল দিয়ে গঠিত, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ ও সুন্দর করেছে।
    পলিমার সাধারণত দুই প্রকার -
    • প্রাকৃতিক পলিমার :
    • সাধারনভাবে প্রাকৃতিক উৎস বিশেষ করে উদ্ভিদ এবং প্রাণি থেকে যে সমস্ত পলিমার পাওয়া যায় তাদেরকে প্রাকৃতিক পলিমার বলে। যেমন - প্রাকৃতিক রাবার, স্টার্চ, তুলা, রেশম, পশম, সিল্ক, উল, পাট ইত্যাদি।
    • কৃত্রিম পলিমার :
    • পরীক্ষাগারে বা শিল্প-কারখানায় কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করেযে সমস্ত পলিমার পাওয়া যায় তাদেরকে কৃত্রিম পলিমার বলে। যেমন - পলিইথিলিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (PVC), পলিস্ট্যারিন, টেফলন, টেরিলিন, নাইলন ইত্যাদি।
  5. সিরামিক ম্যাটেরিয়াল :
  6. সিরামিক গ্রিক শব্দ ’keramics ’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ’মৃৎশিল্প’। সিরামিক হচ্ছে এক ধরনের অজৈব অধাতব সলিড ম্যাটেরিয়াল। অনেক সিরামিক অণুগুলোতে আয়নিক এবং সমযোজী বন্ধনের মিশ্রণ থাকে। ফলস্বরূপ - সিরামিক ম্যাটেরিয়ালগুলো স্ফটিক, আধা-স্ফটিক বা কাচের ন্যায় হতে পারে। সিরামিকের কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে কাদামাটি, কওলিনেট, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড, সিলিকন কার্বাইড ইত্যাদি। কাচামালগুলোকে পানির সাথে মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে মোল্ডের মধ্যে ঢেলে আকার প্রদান করা হয়, শেষে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় তা পোড়ানো হয়। বাসার নিত্য প্রয়োজনীয় থালা-বাসন,মেঝের টাইলস ছাড়াও সিরামিকের বিশাল একটা ক্ষেত্র আছে। উচ্চতাপমাত্রায় কাজ করার যন্ত্র, অপটিক্যাল ফাইবার, ইনসুলেটর, সিমেন্ট, কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি এরকম অনকে জায়গায় সিরামিক লাগে।
  7. কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল :
  8. উপররে ৩ প্রকার ম্যাটরেযি়ালরে সমন্বয়ে যসেব ম্যাটেরিয়াল বানানো হয়, তারাই এর অর্ন্তভুক্ত। কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল হচ্ছে দুই বা ততধিক ভিন্ন শারীরিক এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত ম্যাটেরিয়ালের সংমিশ্রণ। যখন দুইটি ম্যাটেরিয়ালকে একত্রিত করা হয়, তখন সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্যের ম্যাটেরিয়াল তৈরি হয়। কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালকে সংকর ম্যাটেরিয়ালও বলা যেতে পারে। কম্পোজিটের প্রধান দুইটি উপাদান হচ্ছে - ম্যাট্রিক্স এবং ফাইবার। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তি খাতে ফাইবারগ্লাস বহুল ব্যবহৃত কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল।

ধরুন, আপনি ফাইবারগ্লাস তৈরি করতে চান। তাহলে আপনাকে ফাইবার হিসেবে গ্লাস ফাইবার এবং ম্যাট্রিক্স হিসেবে পলিস্টাইরিন রেজিন যুক্ত করতে হবে। ফলে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র গ্লাস ফাইবার একসঙ্গে সংকলিত হবে এবং একটি প্লাস্টিকের পলিমার রেজিন দ্বারা দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হবে। ফাইবারগ্লাসের ক্ষেত্রে, ফাইবার যৌগিক গঠন এবং শক্তি প্রদান করে আর প্লাস্টিকের পলিমার রেজিন (পলিস্টাইরিন) ফাইবারগুলোকে একসঙ্গে রাখে। খেলার র্যাকেট, আধুনকি উচ্চ গতির প্লেনের বডি, সহ আরো অনেক কিছুই কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালসের আওতায় পড়ে।

ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের উৎকর্ষতায় এই চার ধরনের মৌলিক ম্যাটেরিয়াল ছাড়াও ম্যাটেরিয়াল তার বিস্তৃতি ছাড়িয়েছে বহুদূর। বহু জটিল কাজের সমাধান করতে আবিষ্কার হয়েছে অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়াল। অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে রয়েছে - বায়োম্যাটেরিয়ালস, সেমিকন্ডাক্টর, সুপারকন্ডাক্টর ইত্যাদি। অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালকে ছাড়িয়ে সৃষ্টি হয়েছে স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের। স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালগুলো এমন ধরনের ম্যাটেরিয়াল, যারা তাদের উপস্থিত পরিবেশের অনুযায়ী তাদের প্রতিক্রিয়া এবং পূর্বে স্থির করা কার্যপদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারে। স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে রয়েছে - পিজোইলেকট্রিক, শেপ মেমোরি অ্যালোয়, শেপ মেমোরি পলিমার, হাইড্রোজেল ইত্যাদি।

আপনি হয়তো রসায়নবিদ, জীববিজ্ঞানী বা পদার্থবিজ্ঞানীর কথা শুনেছেন, কিন্তু কখনো কোন ম্যাটেরিয়ালস বিজ্ঞানী বা ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্টিস্টের কথা শুনেছেন? সম্ভবত না। তার একটি কারণ হলো ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স রসায়ন, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিস্তৃত ক্রিয়াকলাপকে কভার করে। কখনো কখনো ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্টিস্টদের সিরামিক বা পলিমার ইঞ্জিনিয়ার বা ধাতুবিদ বা করোসন ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়ে থাকে। আপনি তাদেরকে বিশ্ব জুড়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে কাজ করতে দেখতে পাবেন। তবে তারা যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি কাজেও রয়েছে বৈচিত্র্য। ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্টের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পুরনো ম্যাটেরিয়ালগুলোকে বিশ্লেষণ করে সেই লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নত বৈশিষ্ট্যসহ নতুন ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা।
ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সের প্রয়োজনীয় চারটি উপাদান রয়েছে -

  1. আনবিক গঠন ( Atomic Structure)
  2. বৈশিষ্ট্য ( Property )
  3. প্রক্রিয়া (Processes)
  4. কর্মক্ষমতা ( Performance )
https://static.wixstatic.com/media/d0da83_6679386fcf3b49e4b88521bdef680c01~mv2.jpg/v1/fill/w_225,h_234,al_c,q_80,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/d0da83_6679386fcf3b49e4b88521bdef680c01~mv2

একজন ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্ট কোন ম্যাটেরিয়ালের এই চারটি উপাদানের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করার মাধ্যমে ম্যাটেরিয়ালকে জানার চেষ্টা করে। আর এই চারটি উপাদানের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্টরা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নতুন পণ্য তৈরির জন্য হাজারো ম্যাটেরিয়ালের মাঝে পারফেক্ট ম্যাটেরিয়ালটি নির্বাচন করে। এছাড়া ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্টদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ম্যাটেরিয়ালের বিভিন্ন ত্রুটি নির্ণয় করে, সেই ত্রুটিগুলো দূর করার চেষ্টা করা।

মানব সভ্যতার বিজয়রথের চালক হল ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স। সমগ্র মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সের অবদান অপরিসীম । মানব সভ্যতার বাহক হল ম্যাটেরিয়াল|গুহাবাসী মানুষ যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখল, যেদিন নগ্ন গায়ে গাছের ছালকে পরিধেয় হিসাবে ব্যবহার করতে শিখল, সেদিন থেকেই শুরু হল ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সের জয়যাত্রা। ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সের এই জয়যাত্রায় সামিল হয়েছে বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্র। ফলে বিজ্ঞানের সৃষ্টে এই বিজয়রথে চড়ে মানুষ আজ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যাত্রা করছে অনায়াসে| মহাকাশযানে চড়ে পাড়ি দিচ্ছে মহাকাশের বুকে ,মহাকাশের নীহারিকাপুঞ্জ আজ আর রহস্যময় নয় । সাবমেরিনে চেপে মানুষ সমুদ্রের অতল গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনছে মণিমাণিক্য । অভ্রভেদী তুষারাবৃত এভারেস্টেও মানুষ বিজয় পতাকা উড়িয়েছে । দুস্তর মরু পাড়ি দিতেও আজ আর কোনো ব্যাপার নয় । বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় খুলে গেছে সমস্ত রহস্য, অন্ধকার অচেনা জগৎ ।

মানুষ তার সব কল্পনায় বাস্তবে রূপান্তর করে চলছে ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স তথা বিজ্ঞানের কল্যাণে। অটোমোবাইল ইন্ড্রাস্ট্রির কথায় যদি চিন্তা করেন, দেখবেন বিগত কয়েক দশকে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স তাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। অটোমোবাইল ইন্ড্রাস্ট্রি ধাতব ম্যাটেরিয়ালের পরিবর্তে এখন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করছে গাড়ির ওয়াইন্ড টারবাইন ব্লেড সহ অন্যান্য প্রোডাক্ট তৈরিতে। এতে গাড়ির ওজন হ্রাস পেয়েছে, হয়েছে আরো শক্তিশালী আর সাথে সাথে বেড়েছে গতি। BMW'i3 গাড়িটির বেশিরভাগ অংশই কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি। BMW কোম্পানি বলেছে, গাড়ির হালকা ওজনের কারণে একবার চার্জেই গাড়িটি ১০০ মাইল পথ ভ্রমণ করতে পারে। এছাড়া দুর্ঘটনাতে জীবন রক্ষা এবং যানমালের ক্ষতি কমানোর উদ্দেশ্যে অনেক উন্নত ম্যাটেরিয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে যেমন - প্লাস্টিক ফোম।

বর্তমান যুগকে অনেকে ইলেকট্রনিক্সের যুগও বলে থাকে। আপনি আপনার দৈনন্দিন জীবনের দিকেই লক্ষ্য করুন, দেখবেন সকালে অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আপনি কোন না কোন কাজে ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র ব্যবহার করছেন। কিন্তু এই ইলেকট্রনিক্স যুগের উত্থানের গল্পটা কি জানেন? এই ইলেকট্রনিক্সের মহানায়ক কে, সেটা জানেন? এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে অবশ্যই আপনার দৃষ্টিকে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সে নিবদ্ধ করতে হবে। কারণ ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স থেকেই ইলেকট্রনিক্স যুগের উত্থান। ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সই সেমিকন্ডাক্টরের জন্মদাতা। আর এই সেমিকন্ডাক্টরই হচ্ছে ইলেকট্রনিক্সের মহানায়ক। সেমিকন্ডাক্টর থেকেই তৈরি হয়েছে ট্রানজিস্টর। এই ট্রানজিস্টরই হলো আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ গঠনের প্রাথমিক ও মৌলিক উপাদান|আধুনিক ইলেকট্রনিক বলতে কম্পিউটার, মোবাইল, টেলিভিশন এসবই।

ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সের বিচরণ সর্বক্ষেত্রে। পরবর্তী দশকে আমাদের যে বড় বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, চিন্তা করলে দেখবেন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাতে ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সই নেতৃত্ব দিবে।





তথ্যসূত্র :

  1. Materials Science & Engineering, William D. Callister, Wiley India Edition.
  2. Matter and Materials
  3. The Importance of Engineering Materials in Present World, Satya Prakash Pandey1 , Vishwajeet Singh
  4. Materials and Man's Needs: Materials Science and Engineering -- Volume I, The History, Scope, and Nature of Materials Science and Engineering (1975)


Comments (0)